আয়নাঘর কি এবং কোথায় অবস্থিত?

আয়নাঘর

আয়নাঘর কি?

আয়নাঘর হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্র।

আয়নাঘর কোথায়?

‘আয়নাঘর’ ছিল ঢাকা শহরে ডিজিএফআই সদর দফতরের ঠিক পিছনে। সেখান থেকে ছাড়া-পাওয়া এক প্রাক্তন বন্দির কথায়, ”উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং। দক্ষিণে মেস বি। পূর্ব পাশে কয়েকটি সরকারি দফতর।

১৪ আগস্ট, ২০২২-এ, নেত্র নিউজ, একটি সুইডেন -ভিত্তিক স্বাধীন নিউজ পোর্টাল, একটি অনুসন্ধানী হুইসেলব্লোয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে অভিযোগ করে যে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আয়নাঘরে (আয়নাঘর) বলপূর্বক গুমের শিকারদের আটক ও নির্যাতন করছে।

২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যক্তির নিখোঁজ হন ৪০২ জন মানুষ। এ তথ্যটি প্রকাশ করে ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ৪০ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেপ্তার অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০৩ জন এখনও গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌন অবলম্বন করেন। ধারণা করা হয় এসব মানুষদের গুম করে রাখা হয় আয়নাঘরে।

অভিযোগ রয়েছে যে ডিজিএফআই-এর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) আটক কেন্দ্রটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়ী। এখানে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে যেখানে একসাথে ৩০ জন বন্দী রাখার ক্ষমতা রয়েছে। সাইটটি বাংলাদেশের  ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়।

আয়নাঘর থেকে সম্প্রতি মুক্তিঃ

আয়নাঘরে যারা বন্দী থেকেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়।

এছাড়াও আয়নাঘর থেকে সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশী ব্যারিস্টার এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম, সাবেক সামরিক জেনারেল এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা।

‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন মাইকেল চাকমাঃ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কথিত আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। আজ বুধবার ইউপিডিএফ এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হওয়া

ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা দীর্ঘ পাঁচ বছর তিন মাস পর অবরুদ্ধদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোরের দিকে চট্টগ্রামের একটি স্থানে তাঁকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক অংগ্য মারমা আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, মাইকেল চাকমা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। নিরাপত্তার জন্য তাঁকে বিশেষ স্থানে রাখা হয়েছে।

এর আগে গতকাল ভোরে আট বছর পর নিজ বাসায় ফেরেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান) মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং এর কয়েক দিন পর ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়েছিল।

মাইকেল চাকমা নিখোঁজ হয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল। মাইকেল চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সব জাতিসত্তার জনগণ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।

ইউপিডিএফের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে সাংগঠনিক কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক মাইকেল চাকমা গুমের শিকার হন। এর পর থেকে তাঁর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।

মাইকেল চাকমাকে উদ্ধার ও মুক্তির দাবিতে ইউপিডিএফ ও এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠন, প্রগতিশীল ও মানবাধিকার সংগঠন, শিক্ষক-নাগরিক সমাজসহ পরিবারের লোকজন নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সিএইচটি কমিশনসহ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরাও মাইকেল চাকমা গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর সন্ধান দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন।

সংশ্লিষ্ট নারায়ণগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের ও মাইকেল চাকমার সন্ধান চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করা হলেও এত দিন সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলো।

ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি নুতন কুমার চাকমা এক বিবৃতিতে মাইকেল চাকমাকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে মাইকেল চাকমাকে তুলে নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরের অধিক বন্দী করে রাখে।’ তিনি এই গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানান। পাশাপাশি কারাগারে আটক ইউপিডিএফ নেতা আনন্দ প্রকাশ চাকমাসহ সব রাজবন্দীকেও মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান।

বাংলাদেশ বেসরকারি একটি সংবাদ মাধ্যম থেকে ধারণা করছে, যে দেশের বিভিন্ন স্থানে এরকম আরও বেশ কিছু নির্যাতন ও আটক স্থান থাকতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ক্যাপ্টেন (অব.) মারুফ জামান বলেনঃ তিনি দীর্ঘ ১৬ মাস আয়নাঘরে বন্দী ছিলেন। তিনি কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি ‘আয়নাঘর’ তৈরি করার পেছনে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ কয়েকজনকে দায়ী করেন।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বীর প্রতীক তাঁকে একাধিকবার গুম করার ঘটনা তুলে ধরে বলেনঃ এসবের মূল হোতা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তিনি এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির বিচারের দাবি জানান।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. হাসান নাসির বলেনঃ তাঁরা গত রাতে দাবি জানানোর পর দুজন আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছেন। অবশিষ্ট যাঁরা আছেন, যেকোনো মূল্যে তাঁদের মুক্তি দিতে হবে।

আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী বলেনঃ আমাকে গুম করে রাখা হয়। সেটাকে জয়েন্ট ইন্টোরেগেশন সেল বলে। সেটাকে ডেভলপ করে আয়নাঘর বানানো হয়। প্রচুর লোক সেখানে আটকানো আছেন। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সেখানে নির্যাতন চলছে, দীর্ঘদিন তারা রাতে ঘুমাতে পারেন না। এটা একটা স্বাধীন দেশে হতে পারে না। আমরা কারও পরাধীন না। কাউকে এভাবে উঠিয়ে নিয়ে রাখা যায় না।

আয়নাঘরের ভিতরের অবস্থাঃ

আয়নাঘরের দু’টি বিভাগ। একটি ১৬টি কুঠুরির পুরনো বিভাগ। অন্যটি ১০টি কুঠুরির নতুন বিভাগ। প্রতিটি ঘর ‘শব্দরহিত’। ভিতরের আওয়াজ যাতে বাইরে না যায়, তার জন্য প্রতি পাঁচটি ঘরপিছু দু’টি করে বড় এগজ়স্ট ফ্যান লাগানো। ১০টি কুঠুরির নতুন বিভাগটিতে চারটি এগজ়স্ট ফ্যান ছিল বলে জানিয়েছেন হাসিনুর।

এগজ়স্ট ফ্যানের কথা শোনা গিয়েছে দ্বিতীয় প্রাক্তন বন্দি শেখ মোহাম্মদ সেলিম হোসেনের দেওয়া বিবরণেও। তাঁর কথায়, ‘‘ফ্যানগুলো দিনে এক বার বন্ধ হত। বন্ধ হলেই শুনতে পেতাম কান্নার শব্দ। কত লোক কাঁদছে! কোনও কোনও জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আওয়াজটা হঠাৎ বেড়ে যেত!

আয়নাঘরে থাকা ব্যাক্তিদের খাবার কি ছিলো?

খাবার দেওয়া হত পর্যাপ্ত পরিমাণে। তবে তার কোনও সময় ছিল না। কখনও কখনও অনেক সময়ের ব্যবধানে ভরপেট খাবার দেওয়া হত। আবার কখনও কখনও ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পেট ঠেসে খাওয়ানো হত। দেওয়া হত বাংলাদেশের পরিচিত ব্র্যান্ডের মিনারেল ওয়াটারের বোতলের জলও।

আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বলেনঃ আমি সরকারি আমলা ছিলাম, সচিব হয়েছিলাম। পরে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতও হয়েছি। আমাকে কিছু লোক বহুদিন ধরেই ফলো করছিল। আমি ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছোট মেয়েকে আনতে ধানমন্ডির বাসা থেকে যাওয়ার পথে ৮-১০ জন লোক আমার গাড়ি ভেঙে দুইটি পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে আমাকে নিয়ে গেছে। আমাকে আয়না ঘরে নিয়ে এখানে রেখেছে। আমি যেহেতু সেনাবাহিনীর অফিসার, এই ঢাকা সেনানিবাসেই আমি ছিলাম। তাই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে কোথায় রাখা হয়েছে। সেখানে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হতো লোকজনকে। গুটি কয়েক পলিটিক্যাল অফিসার যারা সেনাবাহিনীর মান ইজ্জত ডুবিয়ে দিয়েছে এই ডিজিএফআই থেকে। কত যে লোক মেরেছে তারা, সেটা আল্লাহ জানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *